শৈশবের সোনালী স্মৃতি ও খেলা(Childhood Golden Memories and Games):
শৈশব হলো মানুষের জীবনের সোনালী মুহূর্ত, সেটাকে নতুন করে বাঁচানোর আকাঙ্ক্ষা সবার মনেই থাকে। কিন্তু জীবনের আর বিগত সময় আর ফিরে আসে না, যা পরে থাকে তা হলো স্মৃতি আর সেই স্মৃতি আঁকড়েই বেঁচে থাকি।
আজ আমাদের শৈশবের কথা মনে পড়লে শুধু সোনালি স্মৃতি মনে পড়ে, কারো প্রতি ঘৃণা নেই, কারো প্রতি বিদ্বেষ নেই, সময়ের চিন্তা নেই কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা নেই, শুধু হাসি, খেলা, খাওয়া-দাওয়া, স্কুল আর কিছু নির্বাচিত কিছু কথা। শৈশব জীবন বন্ধুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং খুব সুন্দর ছিল।
আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন মনে মনে প্রায়ই ভাবতাম কবে বড় হবো কিন্তু আজ আবার ফিরে যেতে চাই শৈশবে। তবে চলুন আজ আমরা এই নিবন্ধের মাধ্যমে আপনাকে শৈশবের স্মৃতিতে ফিরিয়া নিয়ে যাই । এই নিবন্ধটি আপনি আপনার বন্ধুদের সাথে ভাগ করে নিয়ে কিছু পুরুনো স্মৃতি স্মরণ করতে পারেন।
শৈশবে ঘুমপাড়ানি গান:
আপনার বয়স যখন কয়েক মাস তখন আপনার মনেও থাকবে না, তখন হয়তো আপনিও অন্যান্য শিশুদের মতো শব্দ করতে করতে ঘুমিয়ে যেত। তারপরে আপনার বাড়ির অন্য কোনও সদস্যের মুখ থেকে ঘুমপাড়ানি গান শুনে আপনি নিশ্চয়ই ঘুমাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বেন
। আমি মনে করি ছোটবেলায় বেশিরভাগ ভারতীয় শিশুরা যে প্রথম ঘুমপাড়ানি গান শুনেছিল তা হবে “আয় আয় চাঁদ মামা“। একটু ভেবে দেখুন সেই সময়টা কতটা সোনালী ছিলো যখন আপনি কিছু না বুঝলেও ঘুমপাড়ানি গানে সেই আওয়াজ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন।
দিদা বা ঠাকুমার গল্প:
বর্তমান সময়ে এই জিনিসটি খুব কমই দেখা যায়, সময়ের ব্যস্ততার কারণে না দিদা বা ঠাকুমা বাচ্চাদের গল্প শোনাতে পারছেন না, টিভি ও মোবাইলের ক্রমবর্ধমান প্রবণতার কারণে শিশুরা এতে আগ্রহ দেখাতে পারছে না। আমরা এটাও বলতে পারি যে আজকের ডিজিটাল যুগে মোবাইল দিদা বা ঠাকুমার জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু আমরা জানি যে যতই সমাজ উন্নত হোকনা কোনো ছোট্ট বেলার সেই দিদা বা ঠাকুমার গল্পের কাছে সমস্ত কিছু হার মানবে, কিন্তু আজকের যুগের বাচ্ছারা সেটা কোনোদিন বুঝবে না। তারা বুঝতেই পারবে না তারা তাদের জীবনের কত বোরো একটা সুন্দর মুহূর্ত হারিয়ে ফেলেছে।
শৈশবের খেলা:
স্কুল থেকে এসে সবার নজর একটাই ছিল, আজকে কি খেলা হবে। ছোটবেলায় খেলা কয়েকটি খেলা ছিল নিম্নরূপ-
লুকোচুরি –
এটি ছিল শৈশবে খেলা সবচেয়ে সহজ এবং মজার খেলা। এতে একজন যে সবাইকে খুঁজবে এবং বাকিরা সবাই লুকিয়ে থাকত, তারপর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সে তার অন্যান্য সঙ্গীদের খুঁজে পেত এবং যে প্রথমে আউট হতো সে পরবর্তীকালে সবাইকে খুঁজবে। ছোটবেলার এই খেলায় স্কুল থেকে ফিরে কখন অন্ধকার হয়ে যেত, কিছুই জানা ছিল না। এই শৈশব খেলা সত্যিই মজা ছিল।
পিঠু –
নিমোর্চা(Nimorcha), যাকে কেউ কেউ সিতোলিয়া বা পিটুক নামেও পরিচিত, আমাদের শৈশবে এটি একটি প্রিয় খেলা ছিল। এই খেলা দুটি দলে ভাগ হয়ে খেলা হতো। এতে কিছু পাথরের টুকরো একটির ওপরে আরেকটি রাখতে হতো এবং যেখানে একটি দলের খেলোয়াড় বলের সাহায্যে কিছু দূরত্বে দাঁড়িয়ে পাথরের টুকরোগুলো ফেলে দিত এবং তারপর তার দল সেই পাথরের টুকরোগুলোকে একটির উপর আরেকটি সাজাবে কিন্তু ওপর দলের সদস্যরা সেই বলটি দিয়ে পাথর গুলো যেই দলের সদস্যরা সাজাচ্ছে তাদের গায়ে মারবার চেষ্টা। যদি দলটি এই পাথরটি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয় তবে এটি একটি পয়েন্ট পেত, অন্যথায় কিন্তু যদি বলটি গায়ে লেগে যায় এই পয়েন্টটি বিপরীত দলকে দেওয়া হত। আর শৈশবে, এই ভাবেই কখন সন্ধ্যা কেটে যেত, কিছুই জানতেই পারা যেত না।
গিলি ডান্ডা –
“গিলিডান্ডা” দুটি টুকরো সরঞ্জাম দিয়ে খেলা হয় – একটি লম্বা কাঠের লাঠি এবং একটি ছোট ডিম্বাকৃতির কাঠের টুকরা। এই খেলাটিতে চার বা তার বেশি খেলোয়াড়ের সাথে খেলা হয়। একটি ছোট বৃত্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে, খেলোয়াড় একটি ঝোঁকা পদ্ধতিতে একটি পাথরের উপর গিলির ভারসাম্য বজায় রাখে, গিলিটির এক দিক মাটিতে স্পর্শ করার সাথে সাথে অন্য দিকটি বাতাসে থাকে। খেলোয়াড় তারপরে উত্থাপিত দিকে গিলিতে আঘাত করার জন্য লাঠি ব্যবহার করে, যা এটিকে বাতাসে উল্টে দেয়। এটি বাতাসে থাকাকালীন, খেলোয়াড় গিলিতে আঘাত করে, যতদূর সম্ভব আঘাত করে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত গিলিটি বাতসে থাকবে ততক্ষন খেলোয়াড় আঘাত করতে। গিলিতে আঘাত করার পরে, খেলোয়াড়কে ওপর খেলোয়াড়রে দ্বারা গিলিটি পুনরুদ্ধার করার আগে বৃত্তের বাইরে একটি পূর্ব-সম্মত বিন্দুতে স্পর্শ করতে হবে। গিলিডান্ডার কোনো নির্দিষ্ট মাত্রা নেই এবং এতে সীমিত সংখ্যক খেলোয়াড় নেই।
ঘুড়ি –
রঙিন ঘুড়ি ওড়ানো সেই রঙিন তারে আকাশ সুন্দর দেখাত। ঘুড়িটিকে আকাশের শীর্ষে নিয়ে যাওয়া এবং এটি কেটে গেলে তার পিছন পিছন দৌড়ানোর মধ্যে একটা আলাদাই আনন্দ ছিল।। আজকে মানুষ একটু হাটতেই হাফিয়ে যায়, তখন আবার কিন্তু তখন মানুষ সেই ঘুড়ির পিছনে দৌড়েও একটাও ক্লান্ত হতো না। এখনের সময়ে ঘুড়ি ওড়ানোর সময় কারোর কাছেই নেই। ঘুড়ি ওড়ানো, মাঞ্জা দেওয়া এখন শুধু স্মৃতির পাতায় রয়ে গেছে।
গ্রীষ্মকালীন খেলা:
স্কুলের সময় যেখানে সন্ধ্যার কয়েক ঘণ্টা খেলার জন্য পাওয়া যেত, সেখানে গ্রীষ্মের ছুটিতে সারা দিনই থাকত খেলাধুলার জন্য। কিন্তু গ্রীষ্মের রোদের কারণে ঘরের বাইরে যাওয়া এবং খোলা জায়গায় খেলা নিষিদ্ধ ছিল, তাই গ্রীষ্মের খেলাগুলিও ছিল আলাদা।
গ্রীষ্মে যে খেলাগুলো খেলা হয় তা হলো-
কেরাম-
গ্রীষ্মের ছুটিতে কেউ ঘর থেকে বাইরে বেরোতো না তাই ঘরের মধ্যেই কেরাম খেলা হতো। আর তা খেলতে খেলতে কখন বিকেল হয়ে যেত তা কেউ বুঝতে পারতাম না।
রাজা মন্ত্রী চোর সিপাহী-
বাড়িতে চারটি কাগজের টুকরের উপর তৈরি এই খেলা চলত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এই চারটি ছিটে রাজা, চোর, মন্ত্রী ও সিপাহী ছিল। আর চারজন আলাদা লোককে এই কাগজের টুকরো তুলতে হতো, যার মধ্যে রাজার চিট ছিল সে বলবে কে আমার মন্ত্রী। এখন যিনি মন্ত্রী হয়েছেন তাকে চোর-সৈনিক খুঁজে বের করতে হবে। যদি তিনি সঠিক চোর এবং সৈনিক কে বলতে পারেন তবে তিনি মন্ত্রীর জন্য 500 নম্বর পেতেন, অন্যথায় তার চিটটি চোরের চিটের ০ দিয়ে প্রতিস্থাপিত হত। এবং রাজা এবং সৈনিক 1000 এবং 250 নম্বর পেতেন। এভাবে শেষ পর্যন্ত খেলায় টোটাল করে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। এই খেলা খেলতে খেলতে সময় কখন ফুরিয়ে যেতো কেউ জানে না। আজও যখন যাত্রায় তাস খেলা হয়, তখন শৈশবের স্মৃতি জীবন্ত হয়ে ওঠে।
ক্রিকেট-
শৈশবে, গ্রীষ্মের সকালে উঠে সমস্ত বন্ধুদের জড়ো করা এবং আলোর আগে মাটিতে পৌঁছে যাওয়াও ছিল অনন্য। পরীক্ষার দিন পড়ালেখায় চোখ না খোলে, ক্রিকেটে কাউকে না তুলে ওঠাটা অদ্ভুত।
লাট্টু-
ছোটবেলার সমস্ত খেলা তার জন্য একটি স্থান আমাদের জীবনে করে দেয় লাট্টুও হলো তেমন একটি খেলা। এই খেলাটি “টস”-এর দ্বারা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং দ্রুত বাছাই করা হয়। ঘূর্ণি ঘূর্ণনের জন্য এটি একটি দড়ি দিয়ে মোড়ানো হয়। এবং আঙুলের মাঝে ওই দড়িটির শেষের অংশ আটকে রাখা হয় তার পর ঘূর্ণর্নটি হাতে করে ধরে মাটির দিকে স্পিন করে দেয়া হয়। এই খেলাটি এমন, এটি যদি না খেলেন বা সমানে থেকে না দেখেন তবে এই কৌশল আপনি বুঝতে পারবেন না।
মার্বেল-
মার্বেল খেলায় আলাদাই আনন্দ, গণনার সময় যত বেশি মার্বেল তার হাতে আসত, ততই মন খুশি হত এবং দুঃখও কম হত।
রুমাল চুরি-
যেখানে স্কুলের ছুটি থাকত এবং সবাই দৌড়ে গিয়ে তাদের ক্লাসের ছেলেমেয়েদের নিয়ে মাঠে জায়গা নিয়ে এই খেলা খেলত। সবাই গোল করে বস্তু এবং একজনেই হাতে একটু রুমাল থাকতো সে তখন তাদের প্রদক্ষিণ করতে করতে কারর একটা পিছনে রুমালটি রেখে দিতো এবং যার পিছনে রাখতো সে যদি বুঝতে পেরে যায় তাহলে পরোক্ষনে সে ছুতে তাকে ছুঁলে সে আউট হ্যা যেত কিন্তু তাকে ছোয়ার আগে যদি সে যার পিছনে রুমাল রেখেছিলো তার জায়গায় বসে পরে তাহলে সে বেঁচে যাবে।
খো-খো-
সবাই খুব সাবধানে খেলত এই খেলাটি, কারণ এটা ছিল প্রতিযোগিতায় আসা একটা খেলা। বছরের শুরুতে, প্রতিটি ক্লাসের দল প্রস্তুত করা হয়েছিল, যার মধ্যে সবাই খুব পরিশ্রম করতো।
সাপ – মই / লুডো-
এটি এমন একটি খেলা যা আমরা প্রায়শই আমাদের মা, বাবা বা ভাইবোনদের সাথে খেলি। সারাদিন পর বাবা বাসায় এলে আমরা জোর করতাম। ক্লান্ত হয়েও বাবা বাচ্ছাদের হাসি দেখে গলে যেতেন আর খেলতে লাগতেন। কখনও কখনও তারা ইচ্ছাকৃত ভাবে হেরে যেত যাতে বাচ্ছাদের মুখে হাসি ফোটে। আর আজকাল বাচ্ছারা বাবা আসার সাথে সাথে মোবাইল নিয়ে যায় আর বাবার সাথে মাথা তুলে কথাও বলে না।
শৈশব সত্যিই আনন্দদায়ক ছিল, আমি চাই শৈশব ফিরে আসুক এবং আমাদের জীবন আবার আনন্দদায়ক হয়ে উঠুক।