কিশোর কুমার | Kishore Kumar

কিশোর কুমারের জীবন কাহিনী

যদি কিশোর কুমার (Kishore Kumar) আজ বেঁচে থাকতেন তাহলে পঁচানব্বই বছরের হতেন। বলিউডের একমাত্র ব্যক্তি কিশোর কুমার যার সিনেমা, যার গানের থেকেও আরও মজার তার জীবন কাহিনী। মানে আপনি যেকোনো গল্প নিন। টাকা নিয়ে এত সীমাবদ্ধতা ছিল যে পরিচালক টাকা না দিলে অর্ধেক মাথা কামিয়ে দিতেন। গান অর্ধেক করে বাকি সুর দিয়ে গুণ গুণ করে বানিয়ে পালিয়ে যেতেন। বি আর চোপড়া একটি খারাপ পর্যায়ে শর্ত রেখেছিলেন তুমি পান খেয়ে আসবে, তারপর গান গাইবে। অমিতাভ বচ্চন ছবিতে অতিথি চরিত্রে অভিনয় করতে রাজি হননি এবং বলেছিলেন আমি আপনার জন্য আর গান গাইবো না। মিঠুন ওনার দ্বিতীয় স্ত্রীকে যখন বিয়ে করেন তখন তিনি বলেন মিঠুনের জন্য জীবনে গান করবেন না। সরকার বলেছিলো বিনামূল্যে গান গাইতে। তখন তিনি বলেন কোথাও গাইব না, টাকা নিয়ে তারপর গান গাইব। সরকার বলেছিল আপনারা জন্যে নিষেধআজ্ঞা করে দেবো, তখন তিনি বলেন কোন ব্যাপার না গান গাইবো না রাখুন।

Kishore Kumar

ক্যান্টিনে কখনো পাঁচ টাকা বারোআনা যদি থাকতো তবে তা নিয়ে একটি গানও তৈরি করে ফেলতেন। কথিত আছে লতা মঙ্গেশকর একবার গান গাইতে আসেনি তখন তিনি মেয়ের কণ্ঠে গানটি গেয়ে দিয়েছিলেন। কখনো দেবানন্দ কে গালিগালাজ করে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এরম সব গল্পের মধ্যে রয়েছে কিশোর কুমারের জীবনি যা শুনে আপনি হাসবেন আর জানলে অবাক হবেন। কিশোর কুমার এতদিন চলে গেছেন, কিন্তু আজকের যুগে কুমার সানু থেকে অভিজিৎ, অমিত কুমার, বিনোদ রাঠোর, কেকে, অরিজিত সিং যাকেই জিজ্ঞেস করবেন সেই বলবে কিশোর কুমার তাদের অনুপ্রেরণা।

কিশোর কুমারের জন্ম স্থান

কিশোর কুমারের কথা খুব কম মানুষই জানেন যার জন্ম পশ্চিমবঙ্গ, কলকাতা হয়নি বরং মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়ায় হয়েছে। কিশোর কুমারের জন্ম ৪ঠা আগস্ট ১৯২৯ এ হয়েছিল খান্ডোয়ায়। ওনারা চার ভাইবোন ছিলো ও চারজন ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন কিশোরজি। বড় ভাই অশোক কুমার একজন সুপরিচিত অভিনেতা। আমরা সবাই জানি তার সম্পর্কে।

অশোক কুমার জানিয়েছিলেন কিশোর কুমারের জন্ম এর প্রথমদিকে তার কণ্ঠস্বর ছিল কর্কশ। তারপর একদিন একটি দুর্ঘটনা ঘটল। কিশোর কুমার বসে ছিলেন ও তার মা সবজি কাটছিলেন আগেকার দিনে যেমন হেসো নিয়ে কাটত। তাই সে সেই কাস্তে/হেসো দিয়ে সবজি কাটছিল। কিশোর কুমার, দৌড়ে যাওয়ার সময় পায়ে লেগে পরে যান এবং কিশোর কুমারের পা কেটে যায়। কাটা যাওয়ায় কিশোর কুমার কাঁদতে থাকে। কয়েক মাস ধরে সে এত চিৎকার করতে থাকে যে এতে তার ভোকাল কর্ড আলাদা হয়ে যায় এবং যিনি একেবারে বেসুরে ছিলেন, তিনি হঠাৎ সুরের কিশোর কুমার হয়ে গেলেন। তাই কিশোর কুমারের ভয়েস ঈশ্বরের দেওয়া ভয়েস ছিল না এটি একটি দুর্ঘটনাজনিত ভয়েস ছিল।

তিনি কোথাও কিছু প্রশিক্ষণ পাননি, তিনি প্রশিক্ষণ ছাড়াই বহু প্রজন্ম ধরে অনেক কিশোর-কিশোরীর অনুপ্রেরণা হয়ে থেকেছেন। কিশোর কুমার ছিলেন এক ভারী মজার মানুষ। তারপর ইন্দোর ক্রিস্টিয়ান কলেজ ছাড়ার সময় ক্যান্টিনে পাঁচ টাকা বারো আনা বাকি রয়ে গেছিলো । তারপর কিশোর কুমার পরে যখন ‘চলতি কা নাম গাড়ি’ মুভি টা পান, তাতে যে গানটা লেখা ছিল সেটা এই পাঁচ টাকা বারো আনা নিয়েই।

কিশোর কুমার বলিউড ডেবুট

কিশোর কুমার বলিউড কেরিয়ার শুরু করেছিলেন তার ভাই অশোক কুমার এর দ্বারা। অশোক কুমার তখন অনেক বড় অভিনেতা হয়ে উঠেছিলেন। অনেক ছবিতে তাকে দেখা গাছে। সেখান থেকেই সুযোগ পেলেন কিশোর কুমার তাদের জন্য কোরাস গাওয়ার। পেছন থেকে যে আওয়াজ আসে তা গাইতেন। পরে ১৯৪৮ সালে একটি মুভি আসে ‘জিদ্দি’ । যেখানে তিনি গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, তারপর মুভি টা হিট হয়ে যায় আর তিনি ধীরে ধীরে বড় তারকা হয়ে উঠতে শুরু করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি পুরোপুরি ভাবে মুম্বাইয়ে আসে এবং ওখানে গিয়ে তার সাথে দেখা হয়ে যায় এক পিতা পুত্র এর সাথে যারা কিশোর কুমার এর জীবন বদলে দিয়েছিলেন ও কিশোর কুমারকে কিংবদন্তি কিশোর কুমার বানিয়েছিলেন তারা হলেন বাবা এস ডি বর্মন, এবং ছেলে আর ডি বর্মণ। কিশোর কুমার ১১৯৮ টা ছবিতে, ২৬৭৮ টা গান গেয়েছেন।

কিশোর কুমারও নকল করতেন। যদিও সবাই অনুকরণ করে যেমন কুমার সানু, সোনু নিগম ও নকল করতেন রফি সাহেব এর। উদিত নারায়ণ রফি সাহেব এর নকল করতেন। কিশোর কুমার নকল করতেন কে এল সেহগালের আর নকল করতেন আমেরিকার গায়ক ডানির। কিশোর কুমারের অনুপ্রেরণা ছিলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু এস ডি বর্মণ স্যার একদিন ডেকে পাঠান, বলেন যদি তুমি দীর্ঘদিন থাকতে চাও, তাহলে কপি করা বন্ধ করতে হবে । তুমি তোমার নিজস্ব স্টাইল আনো। এই কে এল সেহগাল তিনি একজন মহান গায়ক কিন্তু তিনি তার নিজস্ব ধরনের গান করেন। এরপর কিশোর কুমার ছড়া করতেন। যেটা এস ডি বর্মন স্যার দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত হন ও বলেন তুমি যে কাজটি করছো এটাই চালিয়ে যাও। তারপর শুরু হয় ইতিহাস একের পর এক হিট গান।

কিশোর কুমার অর্থের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর

কিশোর কুমার সুপার হিট একমাত্র জিনিস তার অর্থের প্রতি ভালবাসা নিয়ে। মানে কিশোর কুমার টাকার ব্যাপারে একদম নেক্সট লেভেল। ১৯৫৬ সালে অশোক কুমার একটি ছবি পাইয়ে দিয়েছিলেন ‘ভাই ভাই’, পরিচালক ছিলেন এম ভি রমন এই পরিচালক পাঁচ হাজার টাকা কম দিয়েছিলেন। একটি দৃশ্য ছিল কিশোর কুমারকে হাঁটতে হবে ও কিছু সংলাপ বলতে হবে, সে সেসব না বলে বার বার ৫ হাজার টাকা বলে চিল্লিয়ে যাচ্ছিল তখন অশোক কুমার এসে বকা দিল, তখন তিনি বলেন সংলাপ ভুলে গেছি। সে তার দাদাকে ভয় পেত তাই তাকে বকাঝকা করা হয়েছিলো। এর পর অশোক কুমার ভাইকে পায়ের উপর পা রেখে সংলাপ বলতে বললো, না বললে তাকে মারার কথা বলা হয়েছিলো। আরও একবার ঘটেছিল একজন প্রযোজক তাকে কাস্ট করেছে এবং বলেছে পুরো টাকা দেবে, কিন্তু পুরো টাকা দেয়নি।তাই কিশোর কুমার তার অর্ধেক মাথা কামিয়ে তার কাছে গেলেন। তাকে গিয়ে বললেন no money, no honey। পুরো টাকা দিলে কাজ হবে, নইলে এভাবে করুন।

কিশোর কুমার এই সব শুটিং শুরুতে করতেন না। শুটিংয়ের অর্ধেক শেষ হওয়ার পর তিনি এই সব কাজ করতেন। যাতে তারা ফাঁদে পড়ে টাকাটা দিয়ে দেয়। আরেকজন প্রযোজক ছিলেন আরসি তালওয়ার নামে যিনি তাঁকে একটি ছবিতে চুক্তিবদ্ধ করেন এবং তিনি আট হাজার টাকা কম দিয়েছিলেন। কিশোর কুমার ছিলেন সঙ্গীতপ্রিয় মানুষ এবং খুব খোলামেলা মাইন্ডের। কিশোর কুমার তাকে দু-একবার বলেছে টাকাটা দিয়ে দিন। তারপর টাকাটা না দেওয়ায় কিশোর কুমার নতুন আইডিয়া ভেবেছিলেন। তিনি তাদের বাড়ির বাইরে গিয়ে চিৎকার করতেন। হে তালওয়ার, আমাকে আট হাজার টাকা দিয়ে দিন। তারপর তিনি তালওয়ার হাত জোড় করে ক্ষমা চাইছি টাকা নিয়ে নাও, আমার বাড়ির সামনে এমন করো না। আমি অনেক সম্মান অর্জন করেছি খেটে। তবে কিশোর কুমার যে বেশির ভাগ টাকা লুট করেছেন তা নয়। সে রাজেশ খান্না হোক বা ড্যানি স্যার এর জন্য কিছু সিনেমাতেও বিনামূল্যে গান করেছেন। একবার ক্যান্সার হাসপাতালেও বিনামূল্যে পারফর্ম করেছেন। তবে সাধারণত তিনি অর্থের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। মুম্বইয়ের কাঁথার রোডে তাঁর বাড়ির গেটে বোর্ডে লেখা ছিলো কিশোর কুমার হতে সাবধান থাকুন এবং একদিন এক প্রযোজক H S Ravel সে তার বাড়িতে গেছিলো পেমেন্ট দিতে। টাকা দেওয়া হয়েছিল, কিশোর সাহেব টাকা নিয়েছিলেন। ছোট ছেলেমেয়েরা হাতে যেভাবে কেটে দেই তিনি ঠিক সে ভাবেই টাকা নেওয়ার পর কামড়ায়। প্রযোজক বুঝতে পারেনি সে ভাবছে যে এরম কে করে। এরম তো ছোটো ছেলেরা করে থাকে? কিশোর কুমার বলে যে ঘরে ঢোকার সময় আপনি বাইরের বোর্ড পড়েননি। দেখুন বাইরে লেখা আছে। কিশোর সে সাবধান। এই ছিল কিশোর কুমার এর একটি গল্প।

কিশোর কুমারের প্রথম স্ত্রীর নাম রুমা ঘোষ। দ্বিতীয় স্ত্রী মধুবালার ক্যান্সার হয়েছিল। তৃতীয় বার যোগিতা বালি সিংকে বিয়ে করেন। তবে দুই বছর পর তাদের বিয়ে ভেঙে যায়। যখন তাদের বিয়ে ভেঙে যায়, তখন যোগিতা বালিকে মিঠুন বিয়ে করেন। তাই কিশোর কুমার মিঠুন এর উপর রেগে গিয়েছিলেন। আর বলেছিলেন আমি তোমার জন্য গান করতে চাই না, তুমি যা করতে চাও তাই করো। তবে এর পর আবার বিয়ে করেন তিনি। কিন্তু তখন মিঠুন চক্রবর্তীর জন্য কাজ করেননি।

তিনি মহম্মদ রফির একজন বড় ভক্ত ছিলেন। কথিত আছ, মোহাম্মদ রফি সাহেব যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, তখন কিশোর কুমার তার মৃতদেহের পা ধরে হাউ হাউ করে কেঁদেছিলেন। ১৯৭৫ সালে সঞ্জয় এবং গান্ধী ইন্দিরা গান্ধী কিশোর কুমারকে একটা সমাবেশ গান গাইতে বলেছিলেন। তিনি তাদের একজনের কাছে আসেন টাকা নেওয়ার জন্যে কিন্তু টাকা দিচ্ছেলেন না এবং তাকে একটি গান গাইতে বলা হয়েছিল। সে টাকা না পাওয়ায় গান গাইতে চাননি। তাকে বলা হয়েছিলো এটা সরকার এর। বড় মন্ত্রী বলছে তোমাকে গাইতে হবে। তিনি বলেছিলেন সে যেই মন্ত্রী হোক সে প্রধনমন্ত্রী হলেও আমি গান গাইবো না।

তারপর তাকে দূরদর্শন থেকে রেডিও থেকে তার গান নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো। রাফি সাহেব ইন্দিরা গান্ধী ও সঞ্জয় গান্ধীকে খুব ভালো করেই জানতেন। তিনি গিয়ে কিশোর কুমারের গানের নিষেধাজ্ঞা সরানোর জন্য অনুরোধ করেন। ওনার কথা রাখলেন। কিশোর কুমার অবাক হলেন যারা নিষেধাজ্ঞা করলেন তারাই উঠিয়ে দিলেন। পরে জানা গেল রফি সাহেব এটা করেছেন। তিনি রফি সাহেবকে ধন্যবাদ জানালেন, রফি সাহেব বলেছিলেন এ কথা আর কাউকে বলবে না। তিনি মারা যাওয়ায় পর তার সম্পর্কে সব গল্প নিয়ে এসেছিলেন কিশোর কুমার। অশোক কুমার জির ৭৬তম জন্মদিন ছিল ১৯৮৭ সালের ১৩ ই অক্টোবর যেদিন হৃদরোগে মৃত্যু হয় কিশোর কুমারের।

Leave a Comment