টাইটানিকের রহস্য । Mystery of Titanic

টাইটানিকের রহস্য

১৯১২ সালে ১০ ই এপ্রিল বিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে বিলাসবহুল জাহাজ RMS TITANIC তার প্রথম যাত্রা শুরু করেছিল। এটি সাউথ হ্যাম্পটন,ইংল্যান্ড থেকে নিউ ইয়র্ক যাচ্ছিল। এই জাহাজের ভেতরে অনেক ধরনের মানুষ ছিল। বড় শিল্পপতি থেকে অভিনেতা যারা উন্নত জীবনের সন্ধানে আমেরিকা যাচ্ছিলেন। এই জাহাজের কমান্ড পরিচালনা করেছেন বাষট্টি বছর বয়সের সিনিয়র ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড জোন স্মিথ (Edward J. Smith)। এই টাইটানিক জাহাজ নিয়ে যাত্রীদের মধ্যে, জনগণের মধ্যে এবং মিডিয়াতে খুব উত্তেজনা বিরাজ করছিল।

Mystery of Titanic

টাইটানিকের খরচ এবং সাজ সজ্জা

এটি যে শুধু বিশ্বের বৃহত্তম জাহাজ তা নয় এটির দৈর্ঘ্যে ২৬৯ মিটার এবং উচ্চতা ৫৩ মিটারেরও বেশি। তখনকার দিনে এটি তৈরি করতে খরচ হয়েছিল ৭.৫ মিলিয়ন ডলার যা আজকের দিনে যা ৪০০ মিলিয়ন ডলারের সমান। জাহাজের ভিতরের সুবিধা এবং সাজ সজ্জা ফাইভ স্টার হোটেলকেও পিছনে ফেলে দেবে। এর মধ্যে ছিল কাচের জানালা, কাঠের প্যানেলিং, দুটো বিশাল বিশাল সিঁড়ি, একটি হিটেড সুইমিং পুল, টার্কিশ বাথ, ইলেকট্রিক বাথ, একটি জিম, একটি স্কশ কোর্ট, চারটি রেস্তোরাঁ, দুটি সেলুন, একটি লাইব্রেরী ছাড়াও আরও অনেক কিছু।

এই জাহাজটিকে এমনভাবে বানানো হয়েছিল যা কখন ডুবতোই না কারণ এটা খুবই নিরাপদ ছিল। হোয়াইট স্টার লাইন (White Star Line) নামে কোম্পানিটি এই জাহাজটি তৈরি করেছিল এবং এই কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট ফিলিপ এতো টাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে এ বিষয়ে তিনি জনগণের সামনে এসে খোলাখুলি বলেন যে এই জাহাজটি কখনো ডুববে না।

কিন্তু তার প্রথম সমুদ্রযাত্রা শুরু করার মাত্র দুই দিন পর, ১২ ই এপ্রিল, ১৯১২ টাইটানিক বরফের প্রথম সতর্কবার্তা পেতে শুরু করে। মানে আটলান্টিক মহাসাগর যার উপর দিয়ে এই টাইটানিক আমেরিকার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, সেখানে বরফ রয়েছে এই বার্তা পায়। এই তুষার পাহাড়গুলি জাহাজের জন্য খুব বিপদজনক। এই সতর্কতা খুব অস্বাভাবিক জিনিস নয়, জাহাজগুলি তাদের আশেপাশের জাহাজগুলিকে রেডিও এর মাধ্যমে যোগাযোগ করে জানাতে থাকে যে এই সাগরের এই এলাকায় প্রচুর বরফ রয়েছে, সাবধানতার সাথে এগিয়ে যান। এই সতর্কবার্তা পাওয়ার পর টাইটানিক তার পথে বিপদ এড়াতে দু-দুবার ট্রাক পরিবর্তন করে, কিন্তু এর গতি কমানো হয় না। ২১.৫ নটস অর্থাৎ ঘন্টায় ৪০ কিলোমিটার গতিবেগে এই জাহাজ দ্রুত তার নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

টাইটানিকের দুর্ঘটনা

দুদিন পর, ১৪ ই এপ্রিল, ১৯১২ আরও সাতটি আইসবার্গ এর সতর্কতা দেওয়া হয়। কিন্তু ক্যাপ্টেন স্মিথ এবং তার ক্রু এই সতর্কবাণী এড়িয়ে যান, তারা ঠিক করে টাইটানিকের গতি কমাবেন না। ধীরে ধীরে সূর্য অস্ত যায়, রাত হয়ে যায়। তাপমাত্রার ধীরে ধীরে অনেক কমে যায়। এই ১৪ ই এপ্রিলের রাত সম্পর্কে বিশেষ ব্যাপারটা হলো সেই রাতে চাঁদ বেরোয়নি। চাঁদ ছিল না তাই চাঁদের আলোও ছিল না, তাই এই রাতের দৃশ্যমানতা খুব কম ছিল।

জাহাজের সামনের দিকে উঁচুতে একটি ছোট প্ল্যাটফর্ম আছে যা যথেষ্ট উঁচুতে যেটাকে লুকআউট পয়েন্টও বলা যেতে পারে। কাউকে সবসময় এখানে রাখা হয় যাতে জাহাজের সামনে কী আসছে সেদিকে নজর রাখার যায়। কোথাও কোনো বাধা আসছে কিনা সেটা দেখার জন্য। যেই লোকটা এই জায়গায় বসে ছিল তাকে প্রচন্ড ঠান্ডার সম্মুখীন হতে হয়। প্রচন্ড বেগে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছিল, রাতের ঠান্ডা বাতাস এর কারণে চোখ থেকেও জল পড়তে থাকে তার। যা সামনে তাকানোকে আরও কঠিন করে তোলে। রাত ১১ টা ৩৯ মিনিটে ফ্রেডরিক ফ্লিট (Frederick Fleet) নামের এক ব্যক্তি বসে ছিলেন সেই লুকআউট পয়েন্টে। হঠাৎ সে সামনে দেখে, একটা বড় বরফের পাহাড় আছে অর্থাৎ আইসবার্গ আছে। সে দ্রুত তিনবার বেল বাজায় যাতে নিচে বসে থাকা লোকজন শুনতে পায়। তারপর ফোন তুলে সে অফিসারদের ফোন করে চিৎকার করে বলে যে আমাদের সামনে একটা আইসবার্গ আছে, দ্রুত জাহাজ ঘোরান। ফার্স্ট অফিসার মারডক (William Murdoch) তিনি এই নির্দেশ শোনেন এবং ইঞ্জিন ঘরে খবর দেন যে জাহাজকে বাম দিকে ঘুরিয়ে দিন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। মাত্র এক মিনিট পর ১১ টা ৪০ মিনিটে জাহাজটির ডানদিক বরফের স্তূপে ঘর্ষণ খায়।

টাইটানিকের দুর্ঘটনার কারণ

এই আইসবার্গটি ছোট আইসবার্গ ছিল না, ২০০ বাই ৪০০ ফুট দৈর্ঘ্য ছিল একটি ফুটবল ফিল্ড এর মতো বড় এবং উচ্চতা হিসাবে একটি জাহাজের লুক আউট পয়েন্ট পর্যন্ত ছিল। বিজ্ঞানীরা বলেছেন আইসবার্গটির ওজন ছিল ১.৫ মিলিয়ন টন। আইসবার্গের সাথে টাইটানিকের সংঘর্ষটা সামনের ডান দিকে ঘটেছিল। প্রায় দশ সেকেন্ড সময় ধরে এই জাহাজটি বরফস্তূপের গায়ে ঘষে ঘষে চলে যায়, যে কারনে জাহাজের মূল বডিতে কিছু ছোট গর্তও হয়ে গিয়েছিল।

অনেকেই ভাবতে পারেন এটা কিভাবে সম্ভব? কিভাবে একটি বরফ স্তূপ একটি ধাতু কাটতে পারে? মনে রাখবেন একটি বরফ এর পাহাড় তার নিজের ওজন অনেক বেশি। এখন ভাবুন তো কাঠও তো ধাতু কাটতে পারে না। কিন্তু গাড়ি তো ধাতুর তৈরি, সেটি যদি একটি গাছে গিয়ে মারে তখন সম্পূর্ণভাবে সেটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাতে পারে। তাই এই আইসবার্গের ওজন এতটাই বেশিছিল এবং এটি এত বড় ছিল যার কারনে জাহাজটি মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ঘটনার কয়েক সেকেন্ড পর ক্যাপ্টেন স্মিথ (Edward J. Smith) ও জাহাজের আরকিটেক থমাস অ্যান্ড্রুজ (Thomas Andrews) দেখতে যান যে এই ঘটনার প্রভাবে জাহাজটি কতটা ক্ষতি হয়েছে। তারা তা দেখে বুঝতে পারেন যে এই জাহাজটি ডুবে যাবে। এইটা দেখে তারা পুরোপুরি হতবাক হয়ে গিয়েছিল। তারা ভেবেছিল এই জাহাজ তো কখনই ডুবতে পারে না। কারণ জাহাজটির ভিতরে নিরাপত্তা খুব আশ্চর্যজনক ছিল।

এই জাহাজটির দুটি প্রধান নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রথমটি হল জাহাজটিতে একটি ডাবল বটম হাল ছিল, হাল জাহাজের প্রধান শরীরটাকে বলা হয়। ডাবল বটম হাল মানে এতে দুটো লেয়ার বা স্তর ছিল। একটা লেয়ার নিচ থেকে ভেঙে গেলেও অন্য লেয়ার সেভ করবে। এবং দ্বিতীয়টি হল পুরো জাহাজের প্রধান অংশ, যা ষোলটি পৃথক ওয়াটার টাইট কমপার্টমেন্টে বিভক্ত করা ছিল। যদি চারটি কমপার্টমেন্টে জলে ভরে যায় তাও জাহাজ ভাসতে থাকবে, তাতে জাহাজের কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু বরফস্তুপে ঘর্ষণের প্রভাব পড়েছিল জাহাজের পাশে অর্থাৎ সাইডে। তাই ডাবল বটম হাল কোন কাজে আসেনি। সাইডে একটি মাত্রই স্তর ছিলো। বরফস্তূপে ঘর্ষণের ফলে ষোলটির মধ্যে ছয়টি ওয়াটার টাইট কমপার্টমেন্ট জলে ভোরে গিয়েছিল। সীমা ছিল চার পর্যন্ত কিন্তু ছয়টি কমপার্টমেন্ট জলে ভরাট হয়ে গিয়েছিল এর অর্থ ছিল এই জাহাজকে এখন ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচানো যাবে না। এই না ডোবা জাহাজটিও এখন ডুবে যাবে।

সংঘর্ষের প্রায় ২০ মিনিট পর রাত ১২ টার সময় ক্যাপ্টেন স্মিথ তার ক্রু সদস্যদের আদেশ দেন রেডিওতে কল পাঠানোর জন্য, যাতে কাছাকাছি যে জাহাজ থাকবে তারা সিগন্যাল পেয়ে বাঁচাতে আসবে। সিনিয়র রেডিও অপারেটর জ্যাক ফিলিপস (Jack Phillips) গল্পের নায়ক হিসাবে বেড়িয়ে আসেন। তিনি একের পর এক সংকেত পাঠাতে থাকেন। কোন উত্তর আসে না। ২০ মিনিট পর ১২.২০ AM, RMS Carpathia নামে একটি জাহাজ যা টাইটানিকের কাছাকাছি ছিল। রেডিওর এই সংকেতটি তারা পান। টাইটানিক রেডিওর অপারেটরের সাথে কথা বলেন এবং জাহাজটা ঘুরিয়ে টাইটানিকের দিকে যাত্রা শুরু করে তাদের বাঁচানোর জন্য। একমাত্র সমস্যা হল এই জাহাজটি কাছাকাছি ছিল কিন্তু তখনও ১০৭ কিলোমিটার দূরে ছিল। এটি তার সর্বোচ্চ গতিতে ছুটলেও টাইটানিকের কাছে পৌঁছতে সময় লেগে যাবে সাড়ে ৩ ঘন্টা। কিন্তু প্রশ্ন হল টাইটানিকের জাহাজ কি সাড়ে ৩ ঘন্টা টিকে থাকতে পারবে? অন্যান্য ক্রু সদস্যরা,রকেট জ্বালাচ্ছিল, এই আশায় যে কাছাকাছি যদি কোনো জাহাজ থাকে তাহলে সংকেত পাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কারপেথিয়া জাহাজ ছাড়া আর কোনো জাহাজ থেকেই সংকেত পাওয়া যাচ্ছিল না।

এরই মধ্যে ক্যাপ্টেন আদেশ দেন যে জাহাজে উপস্থিত লাইফ বোর্ড ব্যবহার করে যাত্রীদের এখনই সরিয়ে নেওয়া উচিত। প্রটোকল অনুযায়ী বাচ্চাদের ও মহিলাদের প্রথমে লাইফ বোর্ডে এর অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। জাহাজে বসে থাকা যাত্রীরা প্রথমে খুব একটা ভয় পাননি কারণ অধিকাংশ যাত্রীই বিশ্বাস করত যে টাইটানিক কখনই ডুববে না তাই চিন্তার কিছু নেই। এই কারণে যখন প্রথম লাইফ বোট নামানো হয় এটিতে সর্বোচ্চ ৬৫ জন যাতে পারত, কিন্তু লাইফ বোটে গিয়েছিলেন মাত্র ২৮ জন।

কিন্তু সময়ের সাথে সাথে একের পর এক কমপার্টমেন্ট জলে ভরে যেতে থাকে। জাহাজ তখন কাত হতে শুরু করেছিল। ধীরে ধীরে যাত্রীরা সেটা বুঝতে শুরু করেছিল যে জাহাজ ডুবে যেতে পারে এবং যাত্রীরা যখন উপলব্ধি করে, তখন প্রচণ্ড আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রাত ১ টা নাগাদ সামনের দিকের কমপার্টমেন্টে এতোটা ভরে জল গেছিলো যে জাহাজের সামনের দিকটা জলের নিচে ডুবতে শুরু করেছিল। যার কারণে পেছনের অংশটা জল থেকে উপড়ে বেরিয়ে এসেছিলো। জাহাজের পিছন দিকটা যখন অনেক বেশী কাত হতে শুরু করে, তখন খুব হট্টগোল শুরু হয়ে যায়। মানুষ একে অপরের সাথে মারামারি শুরু করে লাইফ বোটে বসার জন্য। কিন্তু সমস্যা ছিল একটাই জাহাজে মাত্র ২০ টি লাইফ বোটস ছিল। যার উপর আনুমানিক মাত্র ১,২০০ লোক যেতে পারবে, তবে জাহাজে প্রায় ২,২০০ কাছাকাছি লোক ছিল। রাত যখন ২ টো বেজে ৫ মিনিট, সেই সময় টাইটানিকের শেষ লাইফ বোট জলে নামানো হলেও জাহাজে ছিল প্রায় ১,৫০০ মানুষ। অনেক মানুষ লাইফ বোটে ঝাঁপিয়ে নিজের জায়গায় করে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তার মধ্যে কিছু মানুষ নিজেদের ভাগ্য মেনে নিয়ে জাহাজেই থেকে গিয়েছিলেন।

টাইটানিক ডোবার শেষ মুহূর্ত

প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে ২ টো বেজে ২০ মিনিটে জাহাজটা দু ভাগে ভেঙে পড়েছিল। তারপর আস্তে আস্তে জলের ভেতর ডুবে গিয়েছিল। তিন ঘণ্টাও লাগেনি, এই না ডোবা জাহাজটি ডুবে যেতে। জাহাজে যে ১,৫০০ লোক ছিল তারাও হয়তো জাহাজের সাথে ডুবে গিয়েছিল অথবা যারা সাঁতার জানতেন তারা হয়ত হাইপোথার্মিয়ার কারণে মারা যান কারণ জলের তাপমাত্রা ছিল -২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রায় কেউ জলে পড়লে কয়েক মিনিটের মধ্যে ঠান্ডায় মারা যাবেন হাইপোথার্মিয়ার কারণে।

কথিত আছে টাইটানিক জাহাজের ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড স্মিথ শেষ অবদি তার জায়গাতেই ছিলেন এবং জাহাজের সাথে ডুবে যান। আবার কিছু মানুষ এটাও বিশ্বাস করেন যে তিনি নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন। RMS Carpathia যে জাহাজটি টাইটানিকের মানুষদের বাঁচাতে আসছিল, সেটি সাড়ে ৩ টে থেকে ৪ টের মধ্যে ওই জায়গায় পৌঁছায়। প্রায় এক ঘণ্টা দেরিতে পৌছানোর কারণে জাহাজে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের বাঁচানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু লাইফ বোটে যে ৭০৫ জন লোক ছিল তাদের এই জাহাজ সফলভাবে রক্ষা করে।

এসএস ক্যালিফোর্নিয়া জাহাজের অবস্থান

এই টাইটানিক বিপর্যয়ের পর অনেক প্রশ্ন উঠেছিল। অনেক বিতর্ক হয়েছিল, অনেক তদন্ত হয়েছিল এবং কিছু অজানা জিনিস প্রকাশিত হয়েছিল যার জন্য সবাই হতবাক ছিল। কেমন লাগবে বন্ধুরা যদি বলি ওই রাতে টাইটানিক ছাড়া আর একটি জাহাজ উপস্থিত ছিল মাত্র ৩৭ কিলোমিটার দূরে যেটি সময় মতো পৌঁছাতে পারত টাইটানিকের যাত্রীদের বাঁচাতে। এটা সত্যি ছিল জাহাজটির নাম ছিল এসএস ক্যালিফোর্নিয়া। টাইটানিক আইসবার্গের সাথে সংঘর্ষের মাত্র এক ঘন্টা আগে সতর্কতা বার্তাটি এসেছিল এসএস ক্যালিফোর্নিয়া জাহাজটি থেকে। তারা বলেছিল সাবধান এই সাগরে এখানে অনেক আইসবার্গ আছে।

তারপর রাত ১১.১৫ মিনিটে ক্যালিফোর্নিয়া জাহাজের রেডিও অপারেটর রেডিও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ক্যালিফোর্নিয়ার জাহাজটি রাতের জন্য থেমে গিয়েছিল। বিপদ দেখে সে আর আগে যেতে চাইনি। ওই জাহাজের রেডিওটি বন্ধ ছিল, এই কারণে জাহাজে কোনো সিগন্যাল পৌঁছাতে পারেনি। টাইটানিকের উপস্থিত কর্মকর্তারা যখন যাত্রীদের লাইফ বোটে তুলছিলেন তখন একজন অফিসার দূরে তাকিয়ে বলেছিলেন দূর থেকে একটি জাহাজ দেখা যাচ্ছে। তারা শীঘ্রই আমাদের বাঁচাতে পৌঁছাবেন, তাই এত চিন্তা করার দরকার নেই।

কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়ার এই জাহাজ তখনো আসেনি যখন টাইটানিক থাকে রকেট নিক্ষেপ করা হচ্ছিল। রাত ১২টার পর ক্যালিফোর্নিয়ায় জাহাজে থাকা ক্রু মেম্বাররা যারা উপস্থিত ছিল তারা আসলে রকেট গুলো দেখেছে যে গুলো টাইটানিক থেকে ছারা হচ্ছিল। তারা তাদের ক্যাপ্টেন স্ট্যানলি লর্ডকে (Stanley Lord) জানিয়ে ছিলেন। কিন্তু ক্যাপ্টেন লর্ড বলেন, এটি টাইটানিকের কোনো ডিস্ট্রেস সিগন্যাল নয় এতে অনেক নাম করা লোকেরা যায়, তারা হয়তো পার্টি করছে।

যদি সেই রাতে ক্যালিফোর্নি জাহাজের ক্যাপ্টেন লর্ড এই রকেটগুলিকে গুরুত্ব সহকারে নিতেন, তবে টাইটানিকে থাকা কত লোকের প্রাণ বেঁচে যেত। পরদিন সকালে রেডিও অন করতেই টাইটানিক থেকে SOS কলগুলি আসে ও তারা তখন সেখানে পৌঁছায় কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। তারা গিয়ে শুধু জলে ভাসমান মৃতদেহগুলি দেখতে পেয়েছিল।

এই তদন্তে ক্যালিফোর্নিয়ার ক্যাপ্টেন স্ট্যানলি লর্ডকে দোষা রোপ করা হয়েছিল। কিন্তু এত বড় বিপর্যয়ের পেছনে শুধু একজন মানুষকে দোষ দেওয়া যায় না। অন্যদেরও অনেক ভুল ছিল। টাইটানিকে যথেষ্ট লাইফ বোট রাখা ছিল না কারণ জাহাজটির নির্মাণকারী কোম্পানির মনে হয়েছিল এই জাহাজটা কখনোই ডুববে না,লাইফ বোটের দরকার নেই।

টাইটানিক জাহাজের ভুল সমূহ

এর বাইরে আর একটি কথা, টাইটানিকের ক্যাপ্টেন তিনি সেফটি ড্রিল পরিচালনা করেননি। যেদিন টাইটানিক আইসবার্গে ধাক্কা লেগেছিল সেদিন একটি সেফটি ড্রিল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ক্যাপ্টেন তা বাতিল করে দিয়েছিলেন কারণ তিনি ভেবেছিলেন এটা তো কখনো ডুববে না।পরবর্তী বড় ভুল ছিল স্টিয়ারিং এ দাড়িয়ে থাকা রবার্ট হিচেন্স (Robert Hichens) এর। সেই রাতে যখন ওপর থেকে খবর আসে সামনে একটা আইসবার্গ আছে, ডেকে উপস্থিত কর্মকর্তা নির্দেশ দেন জাহাজটিকে বাম দিকে ঘুরিয়ে দিতে। কিন্তু আতঙ্কে রবার্ট হিচেন্স বার্তাটি ভুল বুঝেছিলেন এবং ডান দিকে বাঁকিয়ে দিয়েছিলেন। যেটা আইসবার্গের আরো কাছে নিয়ে যাচ্ছিল। যতক্ষণে তিনি তার ভুল বুঝতে পারেন ততক্ষণে খুব দেরি হয়ে গেছে।

ব্রিটিশ অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে যে টাইটানিকে সমস্ত সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছিল, যে এই জায়গায় আইসবার্গ রয়েছে সাবধানে যেতে কিন্তু তবুও গতি না কমিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল জাহাজটি। ক্যাপ্টেন এখানে গতি কমিয়ে দিলেন না কেন? এর পেছনে অনেক থিওরি আছে। একটি জনপ্রিয় থিওরি হল যে কোম্পানি টাইটানিক তৈরি করেছিল অর্থাৎ হোয়াইট স্টারের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক জোসেফ ব্রুশ (Joseph Bruce) তিনি ক্যাপ্টেন স্মিথকে বলেছিলেন যে জাহাজটির গতি কমানো চলবে না। কোম্পানি থাকে ক্যাপ্টেনের উপর প্রেসার দেওয়া হয়েছিল।কারণ তাদের লক্ষ্য ছিল এই জাহাজটি প্রথম যাত্রায় মাত্র ছয় দিনে পৌঁছাতে হবে। যাতে এটি একটি রেকর্ড ভাঙতে পারে। যাতে দেখাতে পারে যে টাইটানিক জাহাজটি কেবল সবচেয়ে বেশি ব্যয়বহুল বা শুধু জাহাজটি সবচেয়ে বড় নয় সাথে দ্রুততম জাহাজও বটে।

১৪ ই এপ্রিল দুপুর ২ টোর সময় যখন ক্যাপ্টেন স্মিথ বরফের সতর্কবাণী দেখেন এবং তারপর গিয়ে জোসেফকে দেখান যে ওই পথে বরফের সতর্কতা আছে, আমাদের গতি কমানো উচিত কিন্তু এই কাগজটি জোসেফ নিয়ে পকেটে রেখে দিয়েছিলেন যাতে লোকেরা বা ক্রু সদস্যরা এই বিষয়ে না জানতে পারে। তিনি চাননি যে জাহাজের গতি কমানো হোক। এই দুর্ঘটনার পর অনেক নতুন নিয়ম এবং মান নির্ধারণ করা হয়েছিল যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্যোগ না ঘটে। ১৯১৪ সালে একটি ইন্টারন্যাশনাল আইস পেট্রোল তৈরি করা হয়েছিল কারণ আইসবার্গ তাদের কাছাকাছি আসলে আগত জাহাজগুলোকে সবসময় সতর্ক করা যাবে। Safety of Life at Sea (SOAL) একটি চুক্তি সাক্ষর করেছিল যে প্রত্যেকটি জাহাজে প্রত্যেক যাত্রীর জন্য যথেষ্ট লাইফ বোটের পরিমাণ থাকা অবশ্যই প্রয়োজন।

টাইটানিকের যে ধ্বংসাবশেষ তা খুঁজতে প্রায় ৭০ বছরেরও বেশি সময় লেগেছিল। সেপ্টেম্বর ১৯৮৫ সালে একজন আমেরিকান মহাসাগর অভিযাত্রী রবার্ট ব্যালট এবং একজন ফরাসি সমুদ্রবিজ্ঞানী গিয়ে সমুদ্রের নিচে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেয়েছিলেন। সমুদ্রের ৩,৮০০ মিটার অর্থাৎ ৩.৮ কিলোমিটারের নীচে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছিল।

এই জাহাজের দুটি ভিন্ন টুকরা পাওয়া গিয়েছিল। এই দুটি টুকরো একে অপরের থেকে ৬০০ মিটার দূরে ছিল। এত বছর পর জলের নীচে ডুবে থাকার কারণে জাহাজটি এবং জাহাজের পরিবেশ ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে গেছে। প্রত্যাশা করা হচ্ছে এই জাহাজটি ২০৩০ সালের মধ্যে জলের নীচে অদৃশ্য হয়ে যাবে। কিন্তু আজকের দিনে ১১০ বছর পরও টাইটানিকের মুগ্ধতা মানুষের মনে অব্যাহত। ২০২১ সালে একজন অস্ট্রেলিয়ান বিলিয়নিয়ার ক্লিভ পালমার (Clive Palmer) পরিকল্পনা করেছিলেন টাইটানিক ২ বানাবেন। একটি আসল টাইটানিক জাহাজের আকারের একটি কপি জাহাজ এমনকি একই রুটে এটি ছুটবে বলেও জানান মডেল এবং জাহাজের ভিতরের প্রতিটি জিনিস হুবহু একই রকম, মূল জাহাজের মতোই তৈরি করা হবে। মূলত এই প্রকল্পটি ২০১৬ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল কিন্তু অনেক বিলম্বের পর ২০২২ এর মধ্যেও এটি শেষ হয়নি। বলা হচ্ছে, যে এই প্রকল্পে মানুষের তেমন আগ্রহ নেই কারণ টাইটানিক জাহাজের সঠিক রেপ্লিকা তৈরি করলে, সেখানে কোনো টেলিভিশন থাকবে না, কোনো WiFi থাকবে না এবং কেউ আসলে এটি ব্যবহার করতেও চাইবে না।

Leave a Comment