জিয়াউল ফারুক অপূর্ব জীবনী । Ziaul Faruq Apurba Biography

জিয়াউল ফারুক অপূর্ব:

জিয়াউল ফারুক অপূর্ব (Ziaul Faruq Apurba) কে বাংলাদেশের নাট্যকর্মী তরুণ-তরুণীদের কাছে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছুই নেই। তিনি শত শত যুবকের আইডল এবং লক্ষ লক্ষ তরুনীর ক্রাস। তিনি জনপ্রিয় একজন নাট্য অভিনেতার পাশাপাশি একাধারে মডেল, চলচ্চিত্র, অভিনেতা, পরিচালক এমনকি সঙ্গীত শিল্পীও। তবে তিনি মূলত বাংলাদেশের বাস্তবিক চরিত্রে অভিনয় করার মাধ্যমে সকলের মনের মনি-কোঠায় জায়গা করে নিয়েছেন। যেমন তার অভিনীত “বড় ছেলে” নাটকের কথা বলা যায়। পরিবার এবং ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করে শত আবেগকে কোরবানি দিয়ে তার অভিনীত সেই নাটকে চোখের জল ফেলেছে কোটি কোটি নাটক প্রেমি তরুণ-তরুণী। এমন শত শত নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমেই তিনি আজকে বাংলাদেশের সেরা নাটক অভিনেতাদের মধ্যে অন্যতম একজন। আজ আমরা জানাবো জনপ্রিয় এই অভিনেতার জীবনের নানান অজানা তথ্য।

Apurba

অপূর্বর জন্ম এবং শৈশব:

অপূর্ব ২৭ শে জুন ১৯৮৩ সালে ঢাকায় শরীয়তপুর জেলায় এক শিল্পী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। চার ভাইবোনদের মধ্যে তিনি হলেন সবার ছোটো। তার মা ফিরোজা আহমেদ রাজশাহী বেতারের একজন শিল্পী ছিলেন। তার দাদু রাজশাহী বেতারের একজন উপস্থাপক ছিলেন। ছোটোবেলা থেকেই অপূর্বর স্বপ্ন ছিল শোবিজ অঙ্গনে কাজ করে নিজেকে অনেক উঁচুতে নিয়ে যাওয়ার। সেই অনুযায়ী তিনি ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের সঙ্গে লেগে ছিলেন। মা ও দাদু বিনোদন জগতের মানুষ হওয়ায় তাদের থেকে সমর্থনটা তিনি যথার্থই পেতেন। এরই মাঝে তিনি পড়াশোনায়ও ছিলেন অনেক সচেতন। অপূর্ব নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ সম্পন্নকারী একজন উচ্চশিক্ষিত অভিনেতা।

অপূর্বর অভিনয় জীবনে আত্মপ্রকাশ:

অপূর্ব অভিনয় জীবনে প্রবেশ করেছেন ফেয়ার এন্ড হ্যান্ডসাম রিয়েলিটি শো এর মাধ্যমে। তারপর ক্যামেরার সামনে দাড়ান অমিতাভ রেজার পরিচালনায় নেস-ক্যাফে কফির বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। এর আগে তিনি ২০০২ সালে “ইউ গট দ্য লুকস” অনুষ্ঠানে “মিস্টার বাংলাদেশ” খ্যাতি অর্জন করে প্রথমবারের মতো সকলের নজরে এসেছিলেন। বৈবাহিক নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে অপূর্ব তার মূলধারার ক্যারিয়ার শুরু করেছেন। যা ২০০৬ সালে গাজী রাকায়েতের পরিচালনায় প্রচারিত হয়েছিল। প্রথম নাটকে অভিনয় করেই তিনি সকলের নজর কাড়েন এবং এর ফলে ওই বছরই অভিনয় করেন একে একে ৮টি নাটকে।

এরপর অভিনেতা অপূর্বকে আর কখনোই পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি আর তিনি একের পর এক সফল নাটক উপহার দিয়েছেন তার প্রিয় দর্শকদেরকে। সাধারণত অপূর্বর রোমান্টিক এবং আবেগি চরিত্রগুলো দর্শকরা খুবই পছন্দ করে থাকেন এছাড়া তিনি সবসময় ন্যাচারাল ধরনের অভিনয় করে থাকেন। সাধারনের মাঝে অসাধারন অভিনয়ের ফলেই তার আজকের এই জনপ্রিয়তা। অপূর্ব অভিনীত কিছু উল্লেখযোগ্য নাটক হচ্ছে, বৈবাহিক, কথা ছিল অন্যরকম, চোখের বাইরে, সরি, কফি হাউস, স্বপ্নের নীলপরী, x-factor, পেজ নাম্বার 27, ব্যাকডেটেড, ভালবাসার চতুস্কোন, অভিমান, মেয়েটির নাম কথা, মা, চান্দের গাড়ি, ফ্যানপেইজ, অবশেষে অন্যরকম স্বপ্নঘুড়ি, সবার উপরে মা, সংসার, খুজি তোমায়, দা হিরো, বড় ছেলে ইত্যাদি।

এখনও পর্যন্ত ২০০ টির কাছাকাছি তিনি টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেছেন। তাঁর অভিনীত নাটকগুলো সবগুলি জনপ্রিয় হয়েছে আর এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে যেটি সেটি হচ্ছে “বড় ছেলে” নামের নাটকটি। এই নাটকটি দেশের মানুষের কাছে এতটাই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে যে নাটকটি কে সিনেমা হলে মুক্তি দিলেও, ইতিহাসের সর্বোচ্চ লোকজন সিনেমা হলে উপস্থিত হতেন এটাই ধারণা করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারপর ২০১৮ সালে – গল্পগুলো আমাদের, শেষ পর্যন্ত, আনমনে তুমি, খেয়ালী আমি হেয়ালি তুমি এছাড়াও আরো অনেক নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন।

অপূর্বর চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ:

অপূর্ব চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় আশিখুর রহমান পরিচালিত “গ্যাংস্টার রিটার্নস” চলচ্চিত্র দিয়ে। ছবিটি ২০১৫ সালের ১৭ ই নভেম্বর মুক্তি পায়। এছাড়া তিনি মোরশেদুল ইসলামের পরিচালনায় বৃষ্টির দিন শিরোনামের একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন, কিন্তু কয়েকদিন শুটিং করার পর ছবিটি বাতিল করা হয়। অপূর্ব নিজের প্রযোজনা সংস্থা এসআই ক্রিয়েশন লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেছেন। এবং ২০১২ সালে তার নিজের প্রযোজনা সংস্থা থেকে ব্যাকডেটেড নামক টেলি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন।

তিনি শিহাব শাহীন নির্দেশিত ভালোবাসার চতুস্কোন ধারাবাহিক নাটকের গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন। অভিনেতা জিয়াউল ফারুক অপূর্ব অভিনয়ের পাশাপাশি মাঝে মাঝে গানও করেন। অভিনয়ে ব্যস্ততার কারণে তিনি অবশ্য ঠিকমতো গানের সময় দিতে পারেন না। তবে সুযোগ পেলে অবশ্যই গান গাইতে চেষ্টা করেন। গান নিয়ে অপূর্ব্ বলেছেন আমি আসলে গানের মানুষ নই আমি হচ্ছি অভিনয়ের মানুষ, আমি ভীষণ লাজুক একটা ছেলে, কেউ স্টেজে ডাকলে আমার অনেক লজ্জা লাগে। তার পরে অবশ্য আমি চেষ্টা করি যে মাঝে মাঝে গান গেয়ে সবাইকে আনন্দিত করতে।

অপূর্ব ২০১৯ সালের ১৮ আগস্ট ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন মডেল এবং অভিনেত্রী সাদিয়া জাহান প্রভাকে। অপূর্ব এবং প্রভার বিয়ের কিছুদিন পরেই প্রভার প্রাক্তন প্রেমিক রাজীবের সঙ্গে অনলাইনে একটি অশ্লীল ভিডি ছড়িয়ে পড়ে। আর সে সময় অপূর্ব এই অবৈধ সম্পর্কের কথা জানতে পেরে ২০১১ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি প্রভার সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ করেন। প্রভাকে ডিভোর্স দেয়ার পর অপূর্ব ২০১১ সালের ২১ শে ডিসেম্বর নাজিয়া হাসান অদিতিকে বিয়ে করেন। অপূর্ব-অদিতি একমাত্র সন্তান জারান ফারুক আয়াস। পিতা এবং পুত্রের জন্ম একি দিনে। বাবার মত ছোট্ট আয়াস বেশ কিছু নাটকে শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে নিয়েছেন। গত বছর ঈদুল আযহার সময়ে বাবার সঙ্গে প্রথমবারের মতো টিভি পর্দায় হাজির হয়েছিলেন এই ছোট্ট অভিনেতা আয়াস। নির্মাতা শিহাব শাহীনের বিনি সুতোর টানে নামক একটি নাটকে বাবার হাত ধরে তার অভিষেক হয়েছিল। এই নাটকটি প্রচারের পর সোশ্যাল মিডিয়াতে বেশ সাড়া পড়ে যায়। জুনিয়র অপূর্ব সে সময় ভাইরাল হয়ে যায়। আসিফ ইকবালের লেখা ও ইশানের গাওয়া গান আমার জন্য তুই পৃথিবী নামের এই গানটিতে অপূর্বর সঙ্গে দেখা গিয়েছিল তার ছেলে আয়াশ কেও । নাটকটি প্রচার হওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ইউটিউবে ২০ লাখেরও বেশি ভিউ হয়েছে আর দর্শকদের বেশিরভাগই প্রশংসা করেছেন অপূর্বর ছেলে আয়াশ এর।

অভিনয়ের বাইরেও তিনি গান করা ছবি আঁকা, বই পড়া, গেমস খেলা এবং চলচ্চিত্র দেখা সহ বিভিন্ন বিনোদন মূলক কাজ করে থাকেন। তারপ্রিয় রঙ হচ্ছে সাদা এবং কালো। ২০১৯ সালে অপূর্ব নিজের লেখা একটি গল্পে একটি বিশেষ নাটকে অভিনয় করেছেন। এই নাটকে অপূর্ব একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসায়ী, স্বভাবে বদমেজাজি নিজেকে তিনি দুর্ভাগা মনে করে থাকেন। এই কারণে তিনি সবসময় নিজেকে রিজার্ভ রাখতে পছন্দ করেন। আশেপাশের সবাই তাকে বেশ সমীহ করে এর মধ্যেই তার পরিচয় হয় টয়ার সঙ্গে। সে এক ছটপটি তরুণী কাউকে পরোয়া করেনা, দুর্ভাগা অপূর্ব একবার জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচে তো আরেকবার সব হিসাব পাল্টে দিতে চাই। এমনই এক গল্পের সেই নাটকটির নাম ছেলেটি ভাগ্যবান ছিল না। নাটকের গল্পের মূল কারিগর অপূর্ব হলেও এর চিত্রনাট্য লিখেছেন রনক ইকরাম আর নাটকটি পরিচালনা করেছেন মহোন আহমেদ।

বড় ছেলে নাটকের তথ্য:

অপূর্ব অভিনীত এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জনপ্রিয় নাটকটির নাম হচ্ছে বড় ছেলে। এই নাটকের মাধ্যমে বেশ কিছু বার্তা দেয়া হয় যা হয়তো বা অনেকেই বুঝে উঠতে পারেননি। তাই চলুন এটা নিয়ে একটা সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যাক। একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় ছেলের উপর যে গুরুদায়িত্ব সেই কাহিনি নিখুঁত ভাবে নাটকটিতে উঠে এসেছে। বাবা অবসর হওয়ার পর সংসার কিভাবে চলবে সেই টেনশানে যখন ছেলেটা একটার পর একটা অফিসে ইন্টারভিউ দিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসছে সেই মুহূর্তে তার প্রেমিকার বাড়ি থেকে একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব আসে কিন্তু বার বার নায়িকা প্রস্তাব ফিরিয়ে দিচ্ছে। অপূর্ব এর সংসারে বাবার অবসরের পর পারিবারিক খরচের বোঝা অপূর্বর ঘাড়ে এসে পড়ে। একজন দায়িত্বশীল পরিবারের বড় ছেলের মতো কিভাবে সে ঠান্ডা মাথায় সবাইকে সান্ত্বনা দিয়ে খরচ সংস্থান করে তা আমাদের মত মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেদের জন্য সত্যিই তা এক রোল মডেল। যা এই নাটকটিতে সুন্দর ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। মাইকেল এঞ্জেলোর একটা উক্তি আমার অনেক প্রিয় মেয়েদেরকে সবথেকে সুন্দর লাগে তাদের কেঁদে ফেলার আগের মুহূর্তে। এই নাটকে অপূর্বর কান্নার আগের মুহূর্ত যদি মাইকেল এঞ্জেলো কখনো দেখতে পেতেন আমার মনে হয় তিনি লিখতেন ছেলে মেয়ে দুজন কেই সবচেয়ে সুন্দর লাগে তাদের কেঁদে ফেলার আগের মুহূর্তে। এই নাটকটি কে রাঙিয়ে দিতে পরিচালকসহ অন্যান্য সকল শিল্পীদের অনেক ভূমিকায় রয়েছে। তবে অপূর্ব নিজেকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন এই বাংলাদেশের বুকে একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবেই তার তুলনা তিনি নিজেই। নাটকটিতে তার সহশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেছেন আরেক জনপ্রিয় অভিনেত্রী মেহজাবিন চৌধুরী। এ নাটকটি পরিচালনা করেছেন মিজানুর রহমান আরিয়ান। নাটক ইউটিউবে এক সপ্তাহে ৪৫ লাখেরও বেশি ভিউস এসেছিল।

এই নাটকটির ব্যাপারে নিজের অনুভূতি প্রকাশের পিছপা হননি তার স্ত্রী নাদিয়াও। বড়ছেলে নাটকের বেশ কয়েকটি দৃশ্যের ছবি নিয়ে তিনি লিখেছিলেন “আমার নিউজফিড ভর্তি শুধু আপনি আর আপনি, গর্ভে আমার বুক ভরে যায় আরো অনেক অনেক ভালবাসা জিতুন”। পরবর্তীতে স্ট্যাটাসটি নিয়ে তিনি বলেন “বড় ছেলে আমি ঈদের সময় টেলিভিশনে দেখেছি আর পরবর্তীতে এটা আমি ইউটিউবে অসংখ্যবার দেখেছি। সত্যি কথা বলতে কি অপূর্ব আসলে একজন গুণী অভিনেতা নাটকটি দেখার পর আমি অপূর্ব কে কল করে বলেছিলাম খুব ভালো হয়েছে অভিনয়। তাছাড়া আমার স্বামীর অভিনীত নাটক দেখে যখন তার অজস্র ভালবাসা জানাচ্ছে তখন দেখি আমার টাইমলাইনে ভরে যাচ্ছে তার ভক্তদের ভালোবাসায়। এই জন্যই আমি স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম”।

শুধুমাত্র এই নাটকটি নয় তারপর আরো কিছু নাটকের দুর্দান্ত অভিনয় প্রতিভার দ্যুতি ছড়িয়ে তিনি দর্শকের কাছে প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছেন। তার অভিনীত প্রতিটি নাটক থেকেই দেশের যুবসমাজের বেশ কিছু শেখার আছে যেমন বড় ছেলে দেখার পর আমি নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি এদেশের কত যুবকই পরিবার-ক্যারিয়ার এসব বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ভালোবাসার টানে ঘর ছাড়া যে ছক একেছিল সেই ছক তারা মুছে দিয়ে মনোযোগী হয়েছেন নিজের ক্যারিয়ার এবং পরিবারের প্রতি। অপূর্ব একজন অতি জনপ্রিয় অভিনেতা তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বেশ জনপ্রিয় এক নাম। এই অভিনেতা বর্তমানে ব্যস্ত সময় পার করছেন নতুন নতুন নাটকের অভিনয়ে।

Leave a Comment